
ফেসবুকের সাত হাজার ১৮৫ জন কর্মীর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজটির দায়িত্ব পালন করছেন আর্তুরো বেজার। ভাবছেন কী আর এমন করেন তিনি? না, তাঁর ঘাড়ে ফেসবুকের বিজ্ঞাপন আয় বাড়ানোর ভার কিংবা সাইটটিকে ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার ভার নেই। কিন্তু তাঁর কাজটি আরও দুঃসাধ্য, আর তা হচ্ছে ফেসবুকের ১৩০ কোটি ব্যবহারকারীকে শিক্ষা দেওয়া। কীভাবে একে অন্যকে সম্মান দিতে হয়, কীভাবে সুন্দরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়, কীভাবে ভদ্রভাবে যোগাযোগ করতে হয় ফেসবুক ব্যবহারকারী তরুণদের সেই শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব ‘মি. নাইস’খ্যাত বেজারের ওপর। তাঁকে নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনটি লিখেছে, ‘সম্মান? তাও আবার অনলাইনে?’ উন্মুক্ত অনলাইনে পরস্পরকে সম্মান দেওয়াটা কখনো সম্ভব নয় বলে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের ভুল প্রমাণ করার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন মি. নাইস। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সবাই জানেন, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট এমন একটি জায়গা, যেখানে পরস্পরকে ছোট করার চেষ্টা থাকে সব সময়ই। বেজারের কাজ সম্পর্কে যদি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়া হয়, তবে অনেকেই হয়তো তাতে মন্তব্য লিখবেন, বোকার মতো কাজ। আবার অনেকে বেজারকেই বলবেন বোকার হদ্দ। এই মন্তব্য নিয়েই তাঁর কাজ। তাই তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে যে মন্তব্যই করা হোক না কেন, সেটি কোন অর্থে করা হচ্ছে, সেটি বিশ্লেষণ করে দেখবেন তিনি।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৮০ লাখ ফেসবুক সদস্য ফেসবুকের টুল ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোস্ট বা ছবি সরিয়ে ফেলার অনুরোধ করেন। বেজার ও তাঁর দল মিলে এই টুলগুলো তৈরি করেন এবং এই টুল ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ তাঁর বিষয়টি ফেসবুককে জানানোর সুযোগ পান। এই পদ্ধতিটি যথেষ্ট কার্যকর বলেও দাবি করেছেন বেজার।
বেজার বলেন, ফেসবুকে সহমর্মিতা সৃষ্টি করা খুব সোজা কাজ নয়। শুধু কয়েকটি অক্ষরই বড় ধরনের প্রভাব ফেলার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন গবেষকেরা। ফেসবুকের কোনো পোস্ট তাদের জন্য বিব্রতকর মনে হলে সেটি সরিয়ে ফেলার অনুরোধ করার জন্য টুল ব্যবহার করা যায়।
ইয়েল সেন্টার ফর ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক মার্ক ব্র্যাকেটও ফেসবুকের প্রটেক্ট ও কেয়ার দলের সঙ্গে মানুষের আবেগ-অনুভূতির বিষয়টি পর্যবেক্ষণে কাজ করছেন। তাঁর দাবি, গবেষকেরা দেখেছেন যে তরুণদের অনুভূতির কথা জানানোর জন্য আরও পথ ও আরও সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
ফেসবুকে কোনো পোস্ট বিব্রতকর মনে হলে, ‘ইটস এমবেরেসিং’ লেখার পাশাপাশি সেই পোস্টটিকে মুছে দেওয়ার জন্য আরও অপশন খোঁজেন তরুণেরা। পোস্টটিতে কী সমস্যা রয়েছে এবং পোস্টটি সম্পর্কে তাঁদের অনুভূতি জানানো সুযোগও রয়েছে। এ ছাড়া পোস্টদাতাকে বিষয়টি জানানোর সুযোগও রয়েছে। ফেসবুক জানিয়েছে, এই ফিচারটি যখন চালু হয়েছিল, তখন ২০ শতাংশ তরুণ পোস্ট মুছে দেওয়ার জন্য প্রদত্ত ফরম পূরণ করতেন। কিন্তু এই ফিচারটিকে যখন আরও উন্নত করা হরো, তখন এর ব্যবহার ৮০ শতাংশ বেড়েছে।
গবেষক ব্র্যাকেট বলেন, ‘পোস্ট সরিয়ে ফেলার অনুরোধ জানাতে ফেসবুক আগে থেকেই তৈরি করা বার্তা দিয়ে রেখেছে। যদি একেবারেই কোনো বার্তা লেখা না হতো, তখন তাঁদের মনে হতো এটা কাজ করবে না।
ব্র্যাকেট বলেন, এ ধরনের বার্তার মাধ্যমে যখন কাউকে জানানো হয় যে, এই পোস্টটির কারণে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কষ্ট পেয়েছেন, তখন পোস্টদাতা সেই পোস্টটি সরিয়ে নিতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায়, কাউকে কষ্ট দেওয়ার বদলে তাঁর সঙ্গে শুধু শেয়ার করার মানসিকতা থেকে এ ধরনের পোস্ট করা হয়ে থাকে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে এমনই একটি প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিল ফেসবুক। অন্যকে কষ্ট দেয় এমন পোস্ট কেন শেয়ার দেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছিলেন, বন্ধুদের ভালো লাগবে জেনেই বা তাঁদের কাছে পোস্টটি মজার হবে জেনেই তাঁরা সাধারণত এ কাজ করেন। মাত্র ২ শতাংশ উত্তর দিল অন্যকে সতর্ক করতে বা অন্যকে বোঝাতে তাঁরা পোস্ট দেন।
ফেসবুকের আরেক গবেষক ড্যাচার কেল্টনার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী ভালো মনে করেই পোস্ট করেন। তাঁদের কাউকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে না।’
সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে মানুষকে আরও বেশি সহমর্মী করে তুলতে, আরও বেশ কিছু উপায় নিয়ে ভাবছেন গবেষকেরা। গত বছরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ১৮৭২ সালে চার্লস ডারউইনের লেখা দ্য এক্সপ্রেশন অব দ্য ইমোশন ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যালস বই থেকে ধারণা নিয়ে মুখভঙ্গির স্টিকার তৈরি করেছিল।
বেজার জানিয়েছেন, তাঁর দলের পরবর্তী কাজ হচ্ছে— শব্দের মাধ্যমে মানুষ কীভাবে তাঁদের অনুভূতি জানাতে পারেন, তা গবেষণা করা। ফেসবুকের কোনো পোস্টে ‘শব্দ’ মন্তব্য হিসেবে ব্যবহার করে নিজের অনুভূতি জানানো যাবে।
আমাদের পরস্পরের মধ্যে আরও বেশি মানবিক গুণাবলি বিকশিত করতে প্রযুক্তিকে আরও বেশি কার্যকর করে তুলতে হবে বলেই মনে করেন ফেসবুকের মি. নাইস।
0 comments:
Post a Comment