
গুগলের জিডিজি সম্মেলনে ছিল বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ, আছে বাংলােদশওভুলটা ভাঙল স্যান হোসেতে গিয়ে৷ ওখানে পৌঁছানোর আগে সবাইকে বলছিলাম, যাচ্ছি গুগলে৷ এটি যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকোর পাশে ছোট শহর স্যান হোসের মাউন্টেন ভিউতে৷ স্যান হোসেতে পৌঁছে জানলাম, এ-তো বিরাট শহর, সানফ্রানসিসকোর চেয়েও বড়৷ আর মাউন্টেন ভিউ আলাদা শহর৷ ছোট কিন্তু এখানে বেড়ে ওঠে দুনিয়া জয় করেছে গুগল, মজিলা, লিংকড-ইন, হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্রতিষ্ঠান৷ ছয় দশক আগে সিলিকন সেমিকন্ডাকটর তৈরি করে ছোট এই শহর পরিচিত হয়ে ওঠে বড় এক ডাকনামে—সিলিকন ভ্যালি৷ পৃথিবীর শীর্ষ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ নিয়ে সানফ্রানসিসকো-স্যান হোসে-মাউন্টেন ভিউ আর আশপাশের ক্যালিফোর্নিয়ার বে-এরিয়া নিয়েই সিলিকন ভ্যালি-তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার রাজধানী৷ পথে বেরোলেই কোনো না কোনো পরিচিত তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় ক্যাম্পাস; পা বাড়ালেই ক্যালিফোর্নিয়া বে-এরিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে গুগল, ইন্টেল, ইবে, আইবিএম, সিসকো, অ্যাডব, ফেসবুক আর টুইটার৷ প্রযুক্তির রাজধানীতে এক সপ্তাহের সফর কাটল এক অন্য রকম রোমাঞ্চ নিয়ে৷
সবুজে প্রযুক্তির ঝলকানি
সিলিকন ভ্যালিতে আমাদের প্রথম গন্তব্য মাউন্টেন ভিউয়ে গুগলের প্রধান কার্যালয়৷ পাহাড়ঘেরা শান্ত, সবুজ শহর; ছিমছাম, বাগানের মতো সাজানো-গোছানো৷ যেতে যেতে পরিচিত সব বিশ্বসেরা প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের নামফলকে চোখ আটকে যায়। একেকটা ভবন একেক রকম৷ তখনো অপেক্ষা গুগল দেখার। গুগলের লোগোসহ কাচঘেরা ভবনটি খুঁজছিলাম৷ এর মধ্যে আমাদের গাইড বললেন, ‘আমরা গুগল ক্যাম্পাসে চলে এসেছি৷’ চারপাশে ছোট-বড় অনেক ভবন, কই সেই ভবন তো দেখছি না! কোথাও গুগল লেখাও নেই! খেয়াল করে দেখলাম সড়কের দুই পাশে গুগলের নামফলক, অনেকটা জায়গাজুড়ে৷ তার মানে এই পুরো এলাকা গুগলের! সেই ভবন পেলাম৷ এটি গুগলের প্রধান ভবন, গুগলপ্লেক্স৷ আর পুরো এলাকাজুড়ে আরও অনেকগুলো ভবন৷ চারদিকে প্রযুক্তিবিশ্বের ঐতিহাসিক আঁতুড়ঘরগুলো রাখা হয়েছে আগের মতো করে৷ খালের পাড়ে ছোট্ট একটা ভবনে জন্ম নিয়েছিল ক্রোম, ওই ভবনের ছয়তলায় গুগল প্লেস্টোর কিংবা ওখানে অ্যান্ড্রয়েড৷ আর গুগলপ্লেক্সে একটু পরপর খাবারের ব্যবস্থা৷ এখানে নাকি ১৮টি ক্যাফেটেরিয়া আছে! ক্যাম্পাসে প্রচুর খেলার জায়গা, টেবিলটেনিস, পিংপং থেকে শুরু করে ভলিবল-বাস্কেটবল৷ আছে মহাকাশ যান থেকে ডায়নোসরের কঙ্কাল—কত কিছু!
হাঁটতে হাঁটতে মিলল চালকহীন গাড়ি ঘুরছে স্ট্রিটভিউয়ের ক্যামেরাসহ৷ পুরো ক্যাম্পাসে অসংখ্য বাইসাইকেল৷ লাল-হলুদ-সবুজ-নীলে গুগলের এই বাইসাইকেলগুলো গুগলারদের যাতায়াতের জন্য৷ অ্যান্ড্রয়েড লনে পার্কের মধ্যে ছড়িয়ে আছে অ্যান্ড্রয়েড আর ফ্রয়ো থেকে ললিপপ পর্যন্ত এর সবগুলো সংস্করণের প্রতীক৷
জিডিজি সম্মেলন
গুগল ক্যাম্পাসে ২৬ ও ২৭ মে গুগল ডেভেলপার্স গ্রুপের (ডিডিজি) বৈশ্বিক সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছিলাম পাঁচজনের একটি দল৷ জিডিজি সোনারগাঁওয়ের ব্যবস্থাপক আশ্রাফ আবির, জিডিজি ঢাকা থেকে আরিফ নেজামি, ইউমেন টেকমেকারের ফারাহ নাজিফা এবং জিডিজি বাংলার ব্যবস্থাপক হিসেবে জাবেদ মোর্শেদ ও আমি। জিডিজি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে গুগল ক্যাম্পাসের পাশেই কম্পিউটার হিস্ট্রি মিউজিয়ামে৷ এটা কম্পিউটারের ইতিহাসসমৃদ্ধ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা৷ চার্লস ব্যাবেজের প্রথম যান্ত্রিক কম্পিউটার থেকে শুরু করে গুগলের স্ট্রিটভিউ কার, সবই আছে৷ জিডিজি সম্মেলনের নির্ধারিত প্রথম আলোচনায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। এতে গুগল অনুবাদে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে গত ২৬ মার্চ সারা দেশে জিডিজি বাংলার আয়োজনে ‘বাংলার জন্য চার লাখ’ কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় ওই দিন বাংলার জন্য অনুবাদের সংখ্যা ছিল সাত লাখের বেশি। সেই সঙ্গে ৫ জুনের মধ্যে বাংলাদেশের এই রেকর্ড ভাঙতে পারলে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয় বাংলাদেশ। সম্মেলনে গুগল ট্রান্সলেট কমিউনিটি ছাড়াও গুগল ডেভেলপার এক্সপার্ট প্রোগ্রাম, গুগল এডুকেশন প্রোগ্রাম, গিটবুক, কন্টেন্ট ডেভেলপমেন্ট, গুগল লঞ্চপ্যাডসহ গুগলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কিছু প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়।গুগলের এই গাড়িই তৈরি করে রাস্তার ছবিসহ মানচিত্র—স্ট্রিটভিউ
চোখ ধাঁধানো আইও
২৮ ও ২৯ মেপ্রযুক্তি বিশ্বের চোখ ছিল সানফ্রানসিসকোর মোসকোনে সম্মেলন কেন্দ্রে৷ এখানেই গুগলের সবচেয়ে বড় বার্ষিক ডেভেলপার সম্মেলন৷ এখান থেকেই ঘোষণা আসে আগামী দিনে কী প্রযুক্তিসেবা বা পণ্য নিয়ে আসছে প্রযুক্তি বিশ্বের প্রভাবশালী এই প্রতিষ্ঠানটি৷ প্রযুক্তিগত চমকের ছড়াছড়ি তো ছিলই, মুগ্ধ করেছে অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যাপকতা প্রযুক্তির সহায়তায় একটা অনুষ্ঠানকে কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তারই একটা গোছানো প্রদর্শনী যেন চোখ আটকে গেল সম্মেলন কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকেই বিরাট হলের তিন দিকের দেয়ালের পুরোটা জুড়ে এক পর্দায় কী না করেছে ওরা৷ ৬০০ ফুটের পর্দায় কখনো পিংপং খেলা হচ্ছে, কখনোবা কোনো তথ্যচিত্র৷ চোখ পর্দার এক মাথা থেকে দৌড়াচ্ছে আরেক পর্দায়৷ চোখ ধাঁধানো আজব এক রঙ্গমঞ্চ৷
এবার এল ঘোষণা৷ গুগল তাদের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের নতুন সংস্করণ অ্যান্ড্রয়েড এম বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে আইও-এ। সেই সঙ্গে আসছে আলাদা লেনদেন ব্যবস্থা অ্যান্ড্রয়েড ক্যাশ, ছবি ও ভিডিও ব্যবস্থাপনার নতুন সেবা গুগল ফটোস, গৃহস্থালি পণ্যের জন্য আলাদা অপারেটিং সিস্টেম, কার্ডবোর্ডের নতুন সংস্করণ, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট টুলসহ আসছে বেশ কিছু নতুন পণ্য।
সেকাল-একালের যুগলবন্দি
সানফ্রানসিসকো ঐতিহ্যবাহী শহর৷ এখানে শত বছরের পুরোনো কেব্ল কার (কলকাতার ট্রামের মতো) চলছে আগের মতোই৷ নিজেদের নির্মাণশৈলীর গর্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে আছে প্রায় শত বছরের গোল্ডেন গেট ব্রিজ৷ পুরোনো ভবনগুলো এ শহরে যেন আগের মতোই চকচকে এখানে৷ পুরোনো ঐতিহ্যকে আগলে রেখেই গত চার দশকে এই শহর রূপ নিয়েছে আধুনিকতম প্রযুক্তির আরেক আবাসস্থলে৷ নতুন-পুরোনোর এক অদ্ভুত সহাবস্থান যেন পুরো সিলিকনভ্যালির চিত্রটা অনেকটা একই রকম৷
0 comments:
Post a Comment