![]() |
বিদেশি বিনিয়োগের ৬০ শতাংশই হয়েছে টেলিখাতে: মাহমুদ হোসেন |
শুরুটা শুধু কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, মোবাইল মানে এখন অনেক কিছু। মোবাইল মানে আরো অনেক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা, আরো অনেক কিছু করার সম্ভাবনা। প্রতিনিয়তই বিশ্বজুড়ে হাজারো মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, মোবাইলকে ঘিরে নতুন সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন; যেগুলো পরবর্তী সময়ে আমরা অ্যাপ বা সেবা হিসেবে ব্যবহার করছি। বাংলাদেশ কি এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে? আপাতদৃষ্টিতে তা মনে হলেও আমাদের অর্জনের দিকটা কিন্তু খুব কম নয়। গত ১৮ বছরে মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারী প্রায় শূন্য থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫ শতাংশেরও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎ বিদেশি বিনিয়োগের ৬০ শতাংশের বেশি হয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতে। দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন লিমিটেডের চীফ কর্পোরেট অ্যাফয়ার্স অফিসার (সিসিএও) মাহমুদ হোসেন বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস উপলক্ষ্যে এক বিশেষ কলামে এসব কথা তুলে ধরেছেন।
মাহমুদ হোসেন
লিখেছেন, এই তো কিছুদিন আগেই ঢাকায় হয়ে গেল 'ডিজিটাল ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০১৫'। এ
সম্মেলনে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন
স্থানীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের নেতা ও বিশ্বের বড় বড় তথ্য ও যোগাযোগ
প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। টেলিনর গ্রুপ, বেসিস ও অ্যাকসেঞ্চার,
বাংলাদেশ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগের
সহায়তায় এ সম্মেলন আয়োজন করে। বাংলাদেশে টেলিনরের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের
প্রতিনিধি হিসেবে এ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল।
সম্মেলনে ডিজিটাল
বাংলাদেশ বাস্তবায়ন ও আইসিটি খাতের উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা এবং এ খাতে আরো দেশি-বিদেশি
বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের
প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক, টেলিনর গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও জন ফ্রেডরিক
বাকসাস, বেসিসের সভাপতি শামীম আহসান। যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংক, সার্চ ইঞ্জিন
গুগল, টেলিফোন অবকাঠামো নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান হুয়াইয়ের প্রতিনিধিরা। তাঁদের আলোচনায়
একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল অর্থনীতি সবার
কাছে ছড়িয়ে দিতে মোবাইল টেলিফোন প্রযুক্তিই হবে প্রধান চালিকাশক্তি।
বাংলাদেশে মোবাইল
ফোন শিল্প গত ১৮ বছরে দেশের ৯৯ শতাংশেরও বেশি মানুষকে নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে
এসেছে, যা অনেক উন্নত দেশের চেয়েও এগিয়ে। আর একই সঙ্গে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের
সুযোগও পাচ্ছে। আর ২০১৩ সালের শেষের দিকে থ্রিজি চালু হওয়ার পর ক্রমেই তারা
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সঙ্গেও পরিচিত হচ্ছে, দ্রুত বাড়ছে এর ব্যবহার। এ মুহূর্তে
মোবাইল নেটওয়ার্কই পারে সারা দেশের মানুষের কাছে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা পৌঁছে
দিতে; আর এর মাধ্যমে ডিজিটাল অর্থনীতির ভিত গড়তে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে
ডিজিটাল অর্থনীতিতে তরুণসমাজই নেতৃত্ব দেবে, তারাই হবে মূল চালিকাশক্তি। আমাদের
দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীরই ২৫ বছরের নিচে বয়স। এ বিবেচনায় আমাদের রয়েছে অমিত
সম্ভাবনা, যা কাজে লাগানোয় হতে হবে প্রত্যয়। গ্রামীণফোনও একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে
চলেছে এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে ডিজিটাল জগতের সব সুবিধা ছড়িয়ে দিতে 'সবার জন্য
ইন্টারনেট' লক্ষ্য স্থির করেছে।
মাহমুদ হোসেনের
তথ্যমতে, বাংলাদেশের সব অঞ্চলে মোবাইল ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে গ্রামীণফোনই অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেছে আর এখন থ্রিজির ক্ষেত্রে একইভাবে এগিয়ে আছে। মাত্র ছয় মাসে ৬৪
জেলায় থ্রিজি নেটওয়ার্ক স্থাপনের পর আমরা এখন উপজেলা পর্যায়ে থ্রিজি পৌঁছে দিতে
কাজ করছি। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সব উপজেলায় পৌঁছানো সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশের
মোট জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশই থ্রিজি নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে। শুধু গ্রামীণফোনই
নয়, তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেটসেবা পৌঁছে দিতে অন্য অপারেটররাও এগিয়ে আসছে।
সামগ্রিক বিবেচনায় এ
কথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে
দাঁড়িয়েছে। এ বিপ্লবের ফলাফল অবশ্যই হবে খুবই ইতিবাচক এবং এর অংশ হতে গ্রামীণফোন
পুরোপুরিই প্রস্তুত। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে অনেক
উন্নতি হয়েছে। ১২ কোটিরও বেশি সক্রিয় মোবাইল সংযোগ আছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর
সংখ্যা ছুঁয়েছে চার কোটি। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একজন নতুন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলছেন,
আর ওডেস্কে নিবন্ধিত হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন বিপুল সংখ্যক তরুণ। এ ছাড়া
জন্মনিবন্ধন থেকে ভূমি রেকর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।
তবে ইন্টারনেটের ব্যবহার এখনো বহুলাংশে বিনোদন ও সামাজিক যোগাযোগনির্ভর রয়ে গেছে।
দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক জীবনে, এর ব্যবহার তেমন
জনপ্রিয় হয়নি।
তাই গ্রামীণফোন
ইন্টারনেট সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে বিশেষ জোর দিচ্ছে এবং কয়েক বছর ধরে
স্কুল পর্যায়ে ইন্টারনেট উৎসব আয়োজন করে যাচ্ছে। তা ছাড়া আমাদের ডিস্ট্রিবিউশন
নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক খুচরা বিক্রেতাকে এ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া
হয়েছে, যাতে তাঁরা গ্রাহকদের ইন্টারনেটের বহুবিধ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করতে
পারেন। তবে মানুষের কাছে ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দিয়ে আর তাদের সচেতন করার মধ্যেই
আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখিনি, সবার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল বা ইন্টারনেটভিত্তিক
সেবা প্রচলনেও আমরা সমানভাবে উদ্যোগী। আমরা চেষ্টা করছি এসব সেবাকে মোবাইল ফোনের
উপযোগী করে তুলতে। এ ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি
ও আর্থিক সেবা বিষয়ে।
মাহমুদ হোসেন বলছেন,
ডিজিটাল সমাজ গড়তে ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।
তবে এ ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষার মানে গুণগত পার্থক্য রয়েছে। এই
পার্থক্য মোচনে আমরা অনলাইন স্কুল নামে একটি কার্যকর মডেল চালু করেছি। দেশের
প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ রকম ১০টি স্কুল চালু হয়েছে, যেখানে ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তির
মাধ্যমে ঢাকা থেকে ক্লাস নিচ্ছেন বিশেষায়িত কেন্দ্রের শিক্ষকরা। এই মডেল
ব্যাপকভাবে প্রচলন করা সম্ভব হলে সারা দেশে শিক্ষার গুণগত মানে সমতা আনার ক্ষেত্রে
বড় অগ্রগতি সাধিত হবে বলে আমরা মনে করি। একইভাবে ঢাকার নামকরা শিক্ষকদের সহায়তায়
আমরা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করছি, যা ইন্টারনেটের
মাধ্যমে দেশের যেকোনো অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা দেখতে পারে। তা ছাড়া ইন্টারনেটে
ইতিমধ্যেই বিদ্যমান এমন অনেক শিক্ষাবিষয়ক কনটেন্ট স্থানীয় ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমেও
এ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের
অর্থনীতির একটি বড় অংশ দখল করে আছে কৃষি এবং সেখানেও শিল্পায়নের ছোঁয়া লেগেছে।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ এখন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে বাজার সম্পর্কে
প্রয়োজনীয় তথ্যের ও সহজে বাজারজাতকরণের অভাবে কৃষক পর্যায়ে এ উন্নয়নের সুফল পুরোপুরি
পৌঁছাচ্ছে না। ইন্টারনেট ও মোবাইল আর্থিক সেবা এ অবস্থার পরিবর্তনে বড় ভূমিকা
রাখতে পারে। কৃষকের জন্য বাজার, কৃষিপ্রযুক্তি ও আধুনিক চাষ পদ্ধতির তথ্য পৌঁছে
দিতে আমরা কাজ করছি। আর মোবাইল আর্থিক সেবা কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পরিশোধকে
সহজ করে তুলবে, মধ্যস্বত্বভোগীর আধিপত্য কমিয়ে প্রান্তিক কৃষকের মুনাফা বাড়াতে
সহায়তা করবে।
স্বাস্থ্য খাতে
প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক সময় নিরাময়যোগ্য ব্যাধিও
মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। ইন্টারনেটভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা বা টেলিমেডিসিন এ সমস্যা
সমাধানে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রামীণফোন বেশ অনেক দিন ধরেই মোবাইলে
স্বাস্থ্যসেবা চালু করেছে, যেখানে রোগী আমাদের কল সেন্টারে কল করে ডাক্তারের
পরামর্শ নিতে পারে। তা ছাড়া খুদে বার্তার মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে
তথ্য প্রদানের কার্যক্রমেও গ্রামীণফোন প্রথম থেকেই জড়িত। টেলিমেডিসিন এ ক্ষেত্রে
নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা যোগ করবে। গ্রামীণফোনের মূল কম্পানি টেলিনর গ্রুপেরও এ
বিষয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে এবং সম্প্রতি তারা বাংলাদেশে সরকারের সঙ্গে ডিজিটাল
সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে কাজ করার জন্য একটি চুক্তি করেছে।
মাহমুদ হোসেন
লিখেছেন, বর্তমানে উন্নত বিশ্বে মেশিন টু মেশিন সংযোগ অর্থাৎ বিভিন্ন যন্ত্রের
মধ্যে স্বয়ংক্রিয় তারবিহীন যোগাযোগের বিষয়টি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও
এটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এরই মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের মেশিনগুলো মোবাইল ফোন
সংযোগের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তবে এর আরো অনেক রকম ব্যবহার হতে
পারে। যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি খাতে বর্তমানে স্মার্ট মিটার স্থাপন করা যেতে
পারে এবং এসব মিটারকে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে যুক্ত করা সম্ভব হলে আরো দক্ষভাবে
ইউটিলিটি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এবং বিল আদায় আরো স্বচ্ছ ও সহজ হবে। তা
ছাড়া যানবাহনগুলোকেও নেটওয়ার্কের আওতায় আনা গেলে সড়ক নিরাপত্তা বাড়বে এবং ব্যবসার
গতি বৃদ্ধি পাবে।
সরকারের সদিচ্ছা ও
অবকাঠামোগত প্রস্তুতির বিচারে বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে
অনেকটা এগিয়ে গেছে। এখন তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করতে মোবাইল
অপারেটরদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে এর জন্য দরকার যথাযথ
যুগোপযোগী নীতিমালা ও বিনিয়োগবান্ধব রেগুলেটরি পরিবেশ। এ ক্ষেত্রে সরকারের
সদিচ্ছার অভাব না থাকলেও সঠিকভাবে নীতিমালার বাস্তবায়ন ও উপযুক্ত রেগুলেটরি পরিবেশ
নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে পদার্পণ দ্রুত
বাস্তবায়িত হবে। আর উন্নয়নের এই বাস্তবায়নে তরুণ প্রজন্মই হবে কাণ্ডারি, হবে
পথিকৃৎ। তারুণ্যের শক্তিই সব কিছুকে অতিক্রম করবে, এটা নিশ্চিত।
0 comments:
Post a Comment